কাপ্তাই লেক ( Kaptai Lake ) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। এর অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে। চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ এবং কাপ্তাই লেকের অথৈ জলরাশি আপনাকে মুগ্ধ করবে। এ লেক ১১০০০ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই কৃত্রিম লেক দক্ষিন এশিয়ার সবচাইতে বড় লেক। এই লেক ভ্রমণে আপনার চোখে পড়বে ছোট বড় পাহাড়, আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা, বাহারি রঙের নৌকা, জল সবুজের মিতালী। এ লেকের একপাশে আছে গাঢ় সবুজ বন গাছ গাছালী, ফুল ফল, হরেক প্রজাতির প্রাণের আবাস। আবার লেকের অথৈ জলে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ আর জলজ জীবের সমারোহ। বর্ষায় ভ্রমণে আসলে আপনি দেখবেন পাহাড়, জল এবং মেঘের খেলায় মেতে আছে এ লেক। লেকের মাঝে পাহাড়গুলোকে মনে হবে এক একটা ছোট ছোট দ্বীপ। লেক এবং বনে ঘুরে বেড়ানো পাখির কলকাকলী, এবং সেখানের মানুষদের জলকেন্দ্রিক জীবন যাপন আপনাকে মুগ্ধ করবে। লেকটি কৃত্রিম হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতি তাকে দিয়েছে অন্যরকম ভালোবাসা, অন্য এক সাজে স্বজ্জিত করেছে এই লেককে। এককথায় বলতে হয় প্রকৃতি তার সমস্ত রূপ উজাড় করে দিয়েছে এই লেকে। কাপ্তাই লেকে সারা বছরই ভ্রমণ করা যায়। তবে বর্ষায় লেকের পাশের ঝর্ণাগুলোতে পরিপূর্ণ যৌবন ফিরে আসে। সেসময় ঝর্ণার প্রেমে আপনি হাবুডুবু খেতে বাধ্য! এই লেকের এক অপরূপ মহিমা আছে যা একবার দেখলে আপনাকে বার বার টেনে নিয়ে যাবে।
ইতিহাস
আমেরিকার সরকারের অর্থায়নে তৎকালীন পাকিস্থান সরকারের আমলে জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কাপ্তাইতে কর্নফুলী নদীর উপর বাঁধ দেয়া হয়। যার ফলে রাঙ্গামাটি জেলার প্রায় ৫৪০০০ একর কৃষি জমি পানিতে প্লাবিত হয়ে দক্ষিন এশিয়ার সবচাইতে বড় লেকের জন্ম হয়।
কি কি দেখবেন
রাঙ্গামাটির পর্যটন শিল্প গড়েই উঠেছে অপরূপ সোন্দর্য কাপ্তাই লেককে ঘিরে। কাপ্তাই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে হলে বোট বা নৌকায় করে লেক ভ্রমণে বের হতে হবে। ঝুলন্ত ব্রীজ এবং রিজার্ভ বাজার ভাড়ায় বোত পেয়ে যাবেন। যা দিয়ে আপনি লেকের সকল স্পট ঘুরে আসতে পারবেন। বোটে করে আপনি প্রথমেই চলে যাবেন নতুন চাকমা রাজার বাড়ি, পুরাতন চাকমা রাজার বাড়ি বাঁধ নির্মাণের পর পানির নিচে তলিয়ে যায়। তারপর যাবেন রাজবন বিহার যা বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম বিহার, যা পূণার্থী এবং দর্শনার্থীদের জন্য আর্কষনীয় স্থান। সেখান থেকেই চলে যাবেন বড়কল উপজেলায় অবস্থিত শুভলং ঝর্ণায়। এখানে পাশাপাশি দুইটি ঝর্ণা রয়েছে। একটি ছোট এবং একটি বড়। ঝর্ণা দেখে চলে যেতে পারেন পেদা তিং তিং, টুকটুক, সেখানে সেরে নিতে পারবেন দুপুরের খাবার। খাবারের পর চলে যেতে পারেন বাংলাদেশ পুলিশের তৈরি পলওয়েল পার্কে। সেখান থেকে যাবেন রাঙ্গামাটির সিগনেচার স্পট ঝুলন্ত ব্রীজে। এইখানেই কায়কিং করার জন্য কায়াক বোট পেয়ে যাবেন। পাহাড় থেকে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে চলে যেতে পারেন কাপ্তাই লেক প্যারাডাইজ পিকনিক স্পটে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়দাবাদ, কমলাপুর, আরামবাগ, কলাবাগান, গাবতলী ও আবদুল্লাপুর থেকে ভালো মানের সব ধরণের বাসই প্রতিদিন রাঙ্গামাটিতে যায়। রাঙ্গামাটিতে চলাচল করা বাসের মধ্যে রয়েছে গ্রীনলাইন, হানিফ, ইউনিক, সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলী, ডলফিন, রিল্যাক্স ইত্যাদি। ঢাকা থেকে নন এসি বাসের ভাড়া ৮৫০৳ – ৯০০৳ আর এসি বাসের ভাড়া ১২০০ – ১৭০০ টাকা। জ্যাম না থাকলে ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি যেতে সময় লাগবে ৭-৮ ঘন্টা। চট্টগামের বি আর টি সি এবং অক্সিজেন থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক গুলো বাস রাঙ্গামাটি চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করে। এইরুটে মোটামুটি ভালো গাড়ি হল পাহাড়িকা এবং বি আর টি সি এর গাড়ি। বর্তমানে গাড়ি ভাড়া ১৭০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামটি যেতে সময় লাগে মাত্র ২ ঘন্টা। ট্রেনে করে সরাসরি রাঙ্গামাটি যাওয়া যায় না তবে আপনি যদি ভ্রমণে রেলের আমেজ চান সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলে যান ট্রেনে। ট্রেন থেকে নেমেই সামনে BRTC এর কাউন্টার সেখান থেকে টিকিট করে বাকি পথটুকু বাসেই ভ্রমণ করুন। বান্দরবান থেকে যেতে চাইলে আপনি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাসষ্ট্যান্ড থেকে রাঙ্গামাটি গামী যেকোন বাসে করে চলে যেতে পারেন রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে বোট ভাড়া করে ঘুরতে পারবেন কাপ্তাই লেক। এছাড়াও রাঙ্গামাটির পর্যটন এলকা ঝুলন্ত ব্রীজ থেকেও নৌকা ভাড়া করে দেখে আসতে পারবেন কাপ্তাই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য।
সাজেক থেকে রাঙ্গামাটি
যারা সাজেক বেড়িয়ে রাঙ্গামাটি যেতে চান তাদের জন্য সহজ উপায় হচ্ছে, সাজেক থেকে সকাল ১০.০০টার স্কটে খাগড়াছড়ি চলে যাবেন। দুপুরেই পৌঁছে যাবেন খাগড়াছড়ি। দুপুরের খাবার খেয়ে খাগড়াছড়ির দর্শনীয় স্থান গুলো ঘুরে নিতে পারেন। তবে সময় অপচয় করবেন না। খাগড়াছড়ির বাস টার্মিনাল থেকে রাঙ্গামাটি যাবার বাস পেয়ে যাবেন। প্রতি ঘন্টায় খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটির উদ্যেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। এই রুটে বাস ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ১৭০-২০০টাকা। সময় লাগবে ০২.০০-০২.৩০ ঘন্টা। এই রুটের বাস গুলো পুরোপুরি লোকাল সার্ভিস দেয় এবং গাড়ি গুলোর মান নরমাল। আপনি যদি আরাম দায়ক ভ্রমণ করতে চান। তাহলে খাগড়াছড়ি থেকে প্রাইভেট গাড়ি রিজার্ভ করে যেতে পারবনে রাঙ্গামাটিতে। গাড়ির মান এবং যাত্রীর সংখ্যা হিসেবে ভাড়া ৬০০০-১০০০০ টাকা পর্যন্ত হবে।
- রেন্ট – এ কারের সার্ভিস নিতে পড়ুন: খাগড়াছড়ির রেন্ট –এ কার সার্ভিস
নৌকা বা বোটের ব্যবস্থা
সকল বাসের সর্বশেষ স্টপিজ রাঙ্গামাটি শহরের প্রান কেন্দ্র রিজার্ভ বাজারে। রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে বোট ভাড়া করে ঘুরতে পারবেন পুরো কাপ্তাই লেকে। এখান থেকে বোট ভাড়া করলে বাড়তি ভাড়া খরচ করে আপনাকে পর্যটন এলাকায় যেতে হবে না।
রিজার্ভ বাজার থেকে বোট বুকিং এর জন্য যোগাযোগ করুন +8801841862600
এছাড়াও রাঙ্গামাটির পর্যটন এলকা ঝুলন্ত ব্রীজ থেকেও নৌকা ভাড়া করে দেখে আসতে পারবেন কাপ্তাই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য। এইখানেই প্রিয়জনের সাথে জলে ঘুরে বেড়ানোর আছে প্যাডেল বোট ও কায়াকিং বোট। লেকের সকল স্পটে যাওয়ার জন্য ভাড়া করে নিতে পারবেন স্পীড বোটও। রিজার্ভ বাজার থেকে যারা বোটে উঠবেন তারা ও স্বাদ নিতে পারবেন প্যাডেল বোট এবং কায়াকিং এর।
খাবার দাবার
একটা সময় কাপ্তাই লেকে খাবার দাবার নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হত পর্যটকদের। বর্তমানে সেই সমস্যা একদম নেই বললেই চলে। পর্যটন বিকাশের সাথে সাথে লেকের মাঝে গড়ে উঠেছে হোটেল মোটেলসহ বেশ কয়েকটি মানসম্মত রেষ্টুরেন্ট। লেকের মধ্যে রেষ্টুরেন্ট গুলো হল ঝুমঘর, টং ঘর, পেদা টিং টিং, চাং পাং। প্রতিটিই রেষ্টুরেন্ট এর খাবার বেশ ভালো। কাপ্তাই লেকে ভ্রমণ করে স্থানীয় খাবারের জন্য এই রেষ্টুরেন্ট গুলো বিখ্যাত। এইসব রেষ্টরেন্টে লেকের মাছের ডিস পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। মাংসের মধ্যে ব্যাম্বু চিকেন পাবেন যার স্বাদ অতুলনীয়। এইসকল রেস্তরার জনপ্রিয় ডিসগুলো হল ব্যাম্বু চিকেন, চিকেন কারি, চিকেন ভর্তা, রুই কেবাং, ব্যাম্বু রুই মাছ, বাচা মাছ কারি, কাচকি মাছ ফ্রাই, ছাপিলা মাছ ফ্রাই, আদার ফুলসহ রুইমাছের ভর্তা, কাচকি মাছের ভর্তা, ছাপিলা মাছের ভর্তা, কলা মৌছা ভর্তা, ডিম কেবাং, বেম্বো সুট ফ্রাই, মিক্স ভেজিটেবল, আদার ফুলসহ মিক্স ভেজিটেবল, স্পেশাল সালাদ, স্পেশাল পাহারী সাবাকাং পাতা দিয়ে সালাদ, ডাল, স্পেশাল বাটার ডাল, পাহাড়ি রং চা, পাহাড়ি কমলা লেবুর চা। এইসকল রেষ্টুরেন্ট সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে। গ্রুপে লোকজন বেশী হলে অবশ্যই যাওয়ার আগেই খাবারের অর্ডার দিয়ে যাবেন। কাপ্তাই লেকে বাংলাদেশ নৌ বাহিনির একটি ভাসমান রেষ্টুরেন্ট রয়েছে যা সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ০৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আপনারা সেখানেও খাবারের পর্ব শেষ করতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
রাঙ্গামাটি শহরে থাকার জন্য বেশ ভালো মানের হোটেল হচ্ছে নাদিশা ইন্টারন্যাশনাল। রাঙ্গামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে বাস থেকে নেমেই আপনি উঠে যেতে পারবেন এই হোটেলে। এই হোটেলে অনেকগুলো রুম রয়েছে ফ্যামেলী রুম, কাপল রুম, সিঙ্গেল রুম। হোটেলের বারান্দা থেকেই উপভোগ করতে পারবেন কাপ্তাই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য। এইখান থেকেই বোটে উঠার ঘাটও খুব কাছে। তাই এই হোটেলটি ভৌগলিকভাবে পর্যটক বান্ধব।
হোটেল বুকিং এর জন্য যোগাযোগ করুন: +8801841862600
এ ছাড়াও শহরে অনেক হোটেল রয়েছে, আপনার সুবিধামত এবং বাজেট অনুযায়ী যে কোন একটা হোটেলে উঠে পড়তে পারেন। বর্তমানে কাপ্তাই লেকেও গড়ে উঠেছে বেশ কিছু উন্নত মানের ইকো রিসোর্ট। সকল রিসোর্টেই আছে আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা। লেকে আরো আছে আধুনিক হাউজ বোট। যার মধ্যে আপনি একই সাথে ঘুরাফেরা এবং রাত্রী যাপন করতে পারবেন। বর্তমানে এই হাউস বোট গুলো পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তাছাড়া সেখানে বেশ কিছু সরকারি গেষ্ট হাউস রয়েছে। যেখানে আপনি অনেক কমমূল্যে রাত্রীযাপন করতে পারবেন। সরাকারি গেষ্ট হাউজগুলো হল, বন বিভাগ, সেনাবাহিনী, পিডিবি, বাঙ্গলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেষ্ট হাউজ।
কাপ্তাই লেকের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান সমুহ
- পেদা টিং টিং
- টুকটুক
- শুভলং ঝর্ণা
- রাজবন বিহার
- চাকমা রাজার বাড়ি
- পলওয়েল পার্ক
- ঝুলন্ত ব্রীজ
- কাপ্তাই বাঁধ
- কর্ণফুলি নদী
- নেভী একাডেমী ইত্যাদি।
কাপ্তাই লেক ভ্রমণে যে বিষয় গুলো অবশ্যই মনে রাখবেন
- স্থানীয়দের সাথে ছবি তোলার আগে অবশ্যই তাদের নিকট হতে অনুমতি নিয়ে নিবেন।
- কাপ্তাই লেকের স্থানীয় আদিবাসীরা অনেক সহজ সরল তাদের সঙ্গে সুন্দর এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করবেন।
- স্থানীয় আদিবাসীদের সংস্কৃতির অসন্মান হয় এমন কিছু ভূলেও করবেন না।
- আর্মিদের এরিয়ায় ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ, তাই সকল ক্যান্টনমেন্ট এবং ক্যাম্পে ছবি তোলা থেক বিরত থাকুন।
- আসার আগে অবশ্যই হোটেল / রিসোর্ট এবং নৌকা বুকিং দিয়ে আসবেন।
- জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি সঙ্গে রাখবেন।
- ভ্রমণে গ্যাজেট সমূহ চার্জের জন্য পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে রাখুন।
- কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য্য এবং পরিবেশ রক্ষায় আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলা থেকে বিরত থাকুন। প্রতিটি বোটেই আছে একটি করে ডাষ্টবিন। ময়লা আবর্জনা সেখানেই ফেলুন। মনে রাখবেন এই লেক আমাদের সম্পদ। একে রক্ষার দায়িত্বও আমাদের।